একটি গোলাপের গল্প

অষ্টম শ্রেণী মানেই অনেকে থার্ডক্লাশ ও বলিয়া থাকেন আমি তাহার সঙ্গে একমত। কারণ সিক্স হইতে গুনিলে থার্ড আবার টেন হইতে গুনলেও থার্ড হইয়া থাকে, তাই ইহার বিরোধীতা করিয়া প্রতিষ্ঠিত যুক্তির বিপরীতে যাইতে চাইনা। তবে,কিছু কিছু মানুষ বেশীর ভাগ ছাত্র ছাত্রীরাই এই থার্ড ক্লাশ শব্দটি বিশেষ অর্থে ব্যবহার করিয়া থাকেন,যাহা দ্বারা তাহারা ইহাই বুঝাইয়া থাকেন যে,বয়সের অপরিপক্বতার শেষে ছাত্র ছাত্রীদের মাঝে যে প্রেম নামক শব্দের পাকামি টা জাগ্রত হয় তাহাই, আমি ইহার ফলাফলের চরম বিরোধিতা করিতে দ্বিধা করিনা। ইহা আমার চরম অসমীচীন বটে।

তাহাতে আর কী’বা হইবে,আমার একা বিরোধীতায় তো আর থার্ডক্লাশ ফাস্ট ক্লাস হইয়া যাইবে না। যাহাই হউক কথার কথা সেই বায়ান্ন কালের কথা মনে পড়িয়া যাইতেছে।
রুবিনা এই মাত্র থার্ড ক্লাশে উঠিয়াছে,আর থার্ডক্লাশ মানেই নানান নতুন গল্প, সেই গল্পের কথাই বলিতেছি যাহা মুখে মুখে বলা হইয়া থাকে,কানাকানি গল্প,মুচকি মুচিকি হাসিবার গল্প। কেউ ফিক করিয়া হাসিলে সবাই বলিয়া থাকে থার্ড ক্লাশের ছাত্রী ইহার চেয়ে আর কীইবা ভালো হইবে। মনে বসন্ত আসিয়া দক্ষিণা বাতাস বহাইতেছে। প্রতিদিনের দেখা ছেলেটিকে তাহার নতুন করিয়া চোখে লাগিয়াছে। এক্সটেন এর ছাত্র। গতকাল রেজাল্ট ঘোষিত হইয়াছে, ছেলেটি প্রথম হইয়াছে। ইহাই রুবিনার দৃষ্টি বদলাইবার মুখ্য কারণ বলিয়াই ধরিতেছি , যদিও থার্ড ক্লাসের ছাত্রী হিসাবেও অন্য কারণ থাকিতে পারে।

একই বিদ্যাপীঠে দুবছর যাবত
দেখা দেখি হইলেও চোখাচোখি হয়নাই। তাই সাহস করিয়া রনির নিকটে যাইবার কোনো উপায় না পাইয়া চিন্তিত হইয়া পড়িল।কিভাবে তাহার নজরে পড়িবার ব্যবস্থা করা যায়। এই সময়টি সাধারণত এমন হইয়া থাকে যে শরীরে পরিবর্তন আসিলেও মাথার পরিবর্তন দেরিতেই আসিয়া থাকে। সুতরাং দূর হইতে ঢিল ছুঁড়িতে আরম্ভ করিলো।

রুবিনা রনির বন্ধুর কাছে পাইভেট সাহায্যে ম্যাথ ও ইংরেজি পড়িয়া থাকে, পড়ার ফাকে ফাকে দীপনের কাছে রনির ব্যাপারে কথা তুলিয়া নানান বিষয়ে জানিতে চেষ্টা করিয়া থাকে।

দীপন একইসঙ্গে বহু ছাত্র পড়াইত,সেখানে সাপ্তাহিক পরীক্ষা লইবার আগে রনির হস্ত লিখন ভালো হইবার নিমিত্ত তাহার নিকট হইতে প্রশ্নপত্রটি লেখাইয়া ফটোকপি করাইত। এই বিষয়টি জানিবার পর হইতে রুবিনা সর্বদা ফটোকপি রাখিয়া মূল কপিটি লইবার প্রত্যয়ে জোরাজুরি করিয়া থাকিত। ইহাতে রুবিনার মূল কপিটি লইবার গোপন রহস্যটি হাটে হাড়ি ভাঙিয়া দিলো। কানপাস করিয়া কথাটি রনির কর্ণ কুহরে প্রবেশ করিলো, রুবিনা মনে মনে তাহার প্রেমের জল খাইয়া বার বার ঢেকুর উঠাইতেছে। কিন্তু ঢেকুরের শব্দে রনির অধ্যায়নের ধ্যান ভঙ্গ হয়নাই। কিছুদিন বাদেই বোর্ড পরীক্ষা।

এক বছর পর

রনি কলেজের ছাত্র, বোর্ড পরীক্ষায় স্কুল ফাস্ট হইয়া এলাকায় সাড়া জাগাইয়া কলেজেও ভালো করিবার প্রত্যয় লইয়া পড়ালেখা করিতেছে। ইহার মধ্যে একবার প্রাইভেট পড়িবার সময় রনীর নাম লেখা ক্যালকুলেটর দীপনের কাছে পাইয়া রুবিনা তাহা অংক কষিবার দোহাই দিয়া বাড়িতে লইয়া গেলো। আর ফিরাইয়া দেবার কথা ভুলিয়া গেলো,ততক্ষণে তাহার থার্ড ক্লাশ পার হইয়া গেলেও স্বভাব বদলাইতে পারে নাই, স্বভাবটি যেন রনির ক্যালকুলেটরে আটকাইয়া গিয়াছে। প্রশ্নপত্র তৈরি করিবার সময় তাহার এক কোনে রনি প্রশ্নপত্রের সৌন্দর্য বর্ধিত করিবার জন্য দুটি পাতা সহ একটি ফুলের ছবি আঁকিত। রুবিনা প্রশ্নপত্র পাইয়া প্রথমেই বুকভরে লম্বা নিঃশ্বাসে সেই ফুলের সুভাস লইতো। ইহা দেখিয়া দীপন আসিয়া রনিকে জানাইতো। রনি তাহা জানিলেও পরীক্ষার চাপে তাহার থার্ড ক্লাসের স্বভাব চাপা দিয়া দম ধরিয়া পড়িতে লাগিলো।

রুবিনা ক্লাসের স্যারের পড়া তৈরি করিতে ভুলিলেও রনির কাছাকাছি যাইবার প্রচেষ্টার কাজটি কখনওই ভুলিত না। দীপনের পাশাপাশি সে রনির বন্ধু বাহাদুরের সাথেও কিছুদিন স্কুলের আনাচে কানাচে দাঁড়াইয়া রনির প্রশংসা ব্যক্ত করিয়াছিলো, যেহেতু বাহাদুর রনি প্রায়শই একসাথে থাকিত তাই টয়লেটের পাশে তাহাদের দুজনের কথা বলিবার একটি দৃশ্য তাহার দৃষ্টি গোরচ হইলো,বিষয়টিতে বেশী কাঠ খড়ি না পুড়াইয়া,রনি নিজ কাজে গমন করিলো। সেই বিষয়টি কলেজ লেভেলে আসিয়া পরিণতিতে উপনিত হইলো।
এলাকায় প্রায়ই হা-ডু-ডু খেলা হইয়া থাকিত , উল্লেখযোগ্য স্বনামধন্য সুপরিচিত একজন খেলোয়াড় ছিলেন রায়হান নাম ক্রিয়া সবাই তাহাকে টাইগার বলেই জানিত।

টাইগার যে মাঠে খেলিতে আসিতো সেখানে আয়োজকরা ভীড় ঠেকাইবার জন্য ছেলে মেয়ে আলাদা করিয়া বসাইবার জন্য বাঁশের খুঁটি পুঁতিয়া বাঁশ বাঁধিয়া দিয়া থাকিতো ইহাতে একটা শৃঙ্খলা রক্ষা হইতো। এমন খেলার মাঠে বাদাম ছোলা বিক্রি হইতো কিন্তু গোলাপ বিক্রি হইতো না।রনি ও বাহাদুর ছেলেদের পাশে একেবারে সামনে পেটের সাথে বাঁশের বেরিকেট ঠেকাইয়া দাড়াইয়া
আর মেয়েদের পাশে এক সারি মানুষের পিছনে রুবিনা,একসারি মানুষ পিছনে থাকলেও রনি,বাহাদুর ও রুবিনা মুখোমুখি হইয়া গিয়াছে। আধো কড়ি প্রষ্ফুটিত একটি গোলাপ রুবিনার হাতে, বার বার হাতের ফুলটি উঁচু করিয়া কাহারো দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা অব্যাহত দেখিয়া রনি বাহাদুর কে বিষয়টি জানালে বাহাদুরও বিষয়টি খেয়াল করিলো। তাহার পর হইতে তিনজনের ভিতরে চোখাচোখি শুরু হইলো, ঈশারা ইঙ্গিত হইলো কিন্তু রুবিনা লোকের ঠেলাঠেলি আর উত্তেজনায় বুঝাইতে পারিলো না যে সে আধো প্রষ্ফুটিত ফুলটি সাথে নিজের হৃদয়টিও কাহার জন্য দিতে চাহিতেছে।

রুবিনা রনিকে তাহার মনের কথা কখনো সরাসরি ব্যক্ত করিতে না পারিলেও মনে মনে লজ্জার পাহাড় গড়িয়া ফেলিয়াছে। যাহা টপকাইয়া তাহার কাছে যাওয়া আর সম্ভব হইতেছে না। খেলা শেষ হইবার পরে ভিড় ঠেলিয়া রুবিনা বাহাদুরের হাতে গোলাপটি দিয়া ভিড় আর চেঁচাচেচির শব্দে রনিকে গোলাপটি দেবার কথা না বলিয়াই চলিয়া গেলো,সে ইহাই ভাবিয়াছিলো যে, বাহাদুর যেহেতু রুনিনার পছন্দের কথা জানিত,সুতরাং গোলাপটি রনিকে দিয়া দিবে। কিছুক্ষণ বাদে স্কুলের খেলার মাঠ ত্যাগ করিয়া পাশের বাজারে পৌছাইবার পর বাহাদুরের হাতে সেই ফুলটি দেখিয়া জিজ্ঞাসা করিলো,ইহা তুই কোথায় পাইলি, উত্তরে বলিল পাগল দেখলিনা এতক্ষণ ধরিয়া অপর দিকে দাঁড়াইয়া ফুল নাড়াইতেছিলো এটা সেই ফুল,হাতে হাতে দিয়া গিয়েছে বন্ধু। রনি অংকটা সহজে মিলাইয়া ফেলিল। স্কুলে থাকতে দুজনের একসাথে কথা বলতে দেখার দৃশ্য আর আজকের ফুল দেওয়া,কিন্তু দীপনের কাছে রনির বিষয়ে ঘটা ঘটিনা গুলো এখন অঘটন মনে হইতেছে। রনির কাছে সব কিছু এলো মেলো লাগিতেছে। কি হইবার কথা আর কি হইতেছে। কলেজের বোর্ড পরীক্ষা সম্মুখে আসিয়া গিয়েছে। যাহাই হউক এসব নিয়া আর মাথা ঘামাইবার সময় নাহি।( বেশির ভাগ মেধাবী ছাত্রগুলো এমনি হইয়া থাকে,তাহাদের পড়া পড়া করিতে করিতে জীবনটা পার করিয়া একসময় বুঝিয়া থাকে তাহার জীবনে অনেক কিছু হারাইয়া গিয়াছে, যখন ইহা বুঝিয়া থাকে তখন আর থার্ডক্লাশের মন থাকে না,মনটি পাকিয়া যায়।আবেগটি কমিয়া আসে,নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করিতে শিখিয়া যায়।) পরিস্থিতি সামাল দিবার জন্য রনি বলিয়া উঠিল কনগ্রাচুলেশনস বন্ধু। দুজনে হাত মিলাইয়া কোলাকুলি করিলো। আগে তাহার কি ছিলো তাহা বুঝিতে না পারিলেও এখন কিছু একটা জানি হারাইয়া গিয়াছে তাহা সে ভালোভাবেই বুঝিতে পারিলো। মনের ভিতর খুতখুত করিতে লাগিলো,বিষণ্ণ হাওয়া বহিতে লাগিলো,ফাকা ফাকা লাগিতেছিলো বুকের ভিতর টা,হঠাৎ কিছু একটা হৃদয় হতে উল্কার মত খসিয়া গিয়া অন্য গ্রহে গিয়া জায়গা করিয়া নিজের মনের ভিতরে বেশ খানিকটা ফাকা করিয়া গেলো। তাহার জন্য আর তার বাজারে থাকিতে ভালো লাগিলো না। সকলের মধ্যে থাকিয়া রনির মনের ভিতরে যে টর্ণেডো বহিয়া গেলো তাহা কেহ বুঝিতে পারিলো না।

2135total visits,4visits today

এস এম মঞ্জুর রহমান

Leave a Reply